(যেটা সবসময় বলা হয়, লেখক হতে গেলে আগে অনেক পড়তে হয়। আমার বেলায় ব্যপারটা একটু ব্যতিক্রম। আমি টিভি দেখে দেখে লেখা শিখেছি। প্রতিদিন গড়ে পাঁচ ঘণ্টা আমি টিভি দেখি। আমার বাসার সবাই আমাকে Couch Potato বলে ডাকে সেইজন্য। স্কুল জীবনে আমি তিনবার গল্প লেখার জন্য পুরষ্কার পাই, যার প্রথম দুটি X-files এর দুটি পর্বের উপর লিখেছিলাম, আর শেষেরটি Twin Peaks এর একটি পর্বের উপর লিখেছিলাম। আমার এই গল্পটিও জাপানিজ এ্যানিমেশন Your Name এর গল্পের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা।)
পর্ব - ১
শারমিনের ঘুম ভাংগার পর ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকালো, নাহ, আজকে সবঠিকই আছে মনেহচ্ছে। মাঝে মাঝে শারমিনের মনে হয় শারমিন, এইখানে নেই, অন্য কোথাও আছে, সেটা বাস্তবের মতো একটা অনুভুতি, কিন্তু পরের দিকে আর কিছুই মনে থাকে না ওর। এটা কি স্বপ্ন, স্বপ্নও মাঝে মাঝে মনে থাকে...কিন্তু শারমিন কিছুই মনে রাখতে পারে না শুধু বুঝতে পারে কিছু একটা ঠিক থাকে না। শারমিনের ছোট বোন নারমিন, ক্লাস ফোর এ পড়ে, ও এসে সাবধানে উঁকি দেয় আর ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করে, “আপু স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে, আজ কি তোমার মাথা ঠিক আছে?!”
নারমিনের এই ভংগি দেখে শারমিনের খুব মায়া লাগে, ইচ্ছে করে ওর একমাত্র বোনটিকে কাছে দেকে আদর করে, কিন্তু ও বিছানা থেকে নেমে নারমিনকে ধরতে গেলে ও দৌড়ে পালিয়ে যায়। শারমিন একটু মন খারাপ করে, আসলেও কি ও পাগল হয়ে যাচ্ছে? বিছানা থেকে নামে স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে নেয় ও। সুন্দর করে ফিতা দিয়ে দুইবেনি করে, ওদের স্কুলে দুইবেনি করা ছাড়া বড় ক্লাসের ছাত্রীরা ক্লাসে ঢুকতে পারে না।
নাস্তা খেতে যায় শারমিন, টেবিলে মা আর নারমিন বসে আছে, মা শারমিনকে দেখে জিজ্ঞাসা করে, “কি রে মা, আজ কি শরীর ভালো? স্কুলে কি যাবি না বাসায় রেস্ট নিবি? নতুন বছরের ক্লাস ঠিকমতো শুরু হয়নাই। তুই চাইলে আজ সারাদিন বাসার থাকতে পারিস।” শারমিন টেবিলে বসতে বসতে মাথা নাড়ে, “আজ শরীর ঠিকই আছে আম্মু। স্কুলে ঘুরে আসলেই ভালো লাগবে, বাসায় একা থেকে কি করবো? দাদীর আসতে দুপুর হয়ে যাবে।”
মার খাওয়া শেষ, শারমিনের কপালে হাত রাখে, গতকালের মতো শারমিন ভয় পেয়ে হাত সরিয়ে দেয় না। আসতে আসতে মা বলে, “ঢাকায় নিয়ে বড় ডাক্তার দেখাতে পারলে শান্তি পেতাম! কি যে হলো তোর! ঠিকআছে, স্কুলে যা কিন্তু খারাপ লাগলে সোজা বাসায় চলে আসবি। গতকালের মতো পাগলামি করিস না কিন্তু! স্যারদের অনেক কষ্টে বুঝিয়েছি!” সাথে সাথে গলা মিলায় নারমিন, “ঠিকই বলেছো আম্মু, গতকালের মতো পাগলামি করলে আমি কিন্তু তোমার মেয়েকে চিনি না...”
ওদের মা হেসে ফেলে, কিন্তু দুশ্চিন্তা চাপা দিতে পারে না, “আরে না, আজকে আমার বড় মেয়ে ভালোই থাকবে! আমি কিন্তু আজ সদরে যাবো, ফিরতে বিকাল হয়ে যাবে। খাবার রান্না করা আছে, শারমিন গরম করে খেয়ে নিস।”
এই বলে দুইমেয়ের কপালে চুমু দেয় ওদের মা। অন্য দিনের মতো শারমিনকে হাত ধরতে দেয় না নারমিন, শারমিন হাত ধরতে গেলে নারমিন বলে, “আপু আগে তোমার মাথা ঠিক হয়ে নিক, তারপর তোমার হাত ধরবো, আমার কিন্তু ভয়ভয় লাগছে, আজ বাসায় থাকলেই পারতা!” নারমিন কে আশ্বস্ত করে শারমিন, “আরে না দেখিস, আজ কিছুই হবে না, কেন জানি মনেহচ্ছে আজ মাথা ঠাণ্ডাই থাকবে!” আশ্বস্ত হয় না নারমিন, একটু জোরে জোরে শারমিনকে পিছনে ফেলে হাঁটতে থাকে। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে, শারমিনরা থাকে এমন একটা গ্রামে যেটার চারদিক দিয়েই পদ্মা নদী, শরীয়তপুর জেলার এই গ্রামটিতে শীতকালে বেশ ভালো ঠাণ্ডা পড়ে। শারমিন স্কার্ফটা মাথায় ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে নারমিনকে ধরার জন্য জোরে পা চালায়। কুয়াশার জন্য বেশিদূর দেখা যাচ্ছে না, পিছন থেকে শারমিন শুনতে পায় ওর নাম নিয়ে কেউ ডাকছে, বুঝতে পারে ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু সাদিয়ায় গলা। রাস্তার একদিকে ওর জন্য দাঁড়ায় শারমিন, দেখে সুলতানের সাইকেলের সামনে বসে সাদিয়া আসছে! মনে মনে একটু হেসে নেয় শারমিন কারন এদের দুইজনকে বেশ মানায়! সুলতান শারমিনের সামনে সাইকেল থামায়, সাদিয়া সাইকেল থেকে নেমে পড়ে শারমিনের উদ্দেশ্যে বলে, “কিরে শারমিন...আজ কেমন আছিস? কাল যে হিরোগিরি দেখালি...আজতো তুই পুরাই ফেমাস!!” সাথে সুলতানও হাসতে হাসতে গলা মিলায়, “সত্যি কইতাসি শারমিন, তোমার খেলা দেইখা মাথা আউলা অবস্থা! শয়তান রাজুরে যে মাইর দিসো!! মোবাইলে আলম ভিডিও কইরা রাখসে! সারাজীবন রাজুর তোমার মাইর মনে থাকবো!!”
শারমিন চিন্তায় পরে যায়, ভাবে ওর মার কানে এইসব খবর গেলো কিনা! ওর মুখ ভার দেখে সাদিয়া বলে উঠে, “নো টেনশন বন্ধু, গুন্ডা রাজু এতো মাইর খাইসে, তাও তোর মতো একজন হাবাগোবা মেয়ের কাছে যে, ও কাউরেই এই খবর বলবে না! তা আজ কিসের ভেল্কি দেখাবি বনু?!” শারমিন মলিন মুখে মাথা নাড়ে, “নারে, আজ কোন কিছু করবো না, আজ আমি হাবাগোবা শারমিন, দোয়া করিস আর যেনো কোন পাগলামি না করি!!”
“আরেহ না, পাগলামি কিসের?! আমার মনেহয় কোন ভালো ভুতের কাজ, তোমার উপর ভর করসে! ভুতটা কিন্তু খুব ভালো! আমার খুবই পসন্দ!! হাহাহা!!” সুলতান জোরে হেসে ফেলে! সুলতান সাইকেল নিয়ে হাটতে থাকে শারমিন আর সাদিয়ার পাশেপাশে। তিনজনের ছোট দলটা স্কুলে পৌঁছে যায়, শারমিন প্রথমে নারমিনের ক্লাসরুমে ঢুকে দেখে ও ঠিকমতো বসছে কিনা, সাধারণতঃ নারমিন একমাত্র বড়বোনকে নিয়ে অনেক গর্ব করে, নারমিন ওর সব বন্ধুদের সাথে কথা বলিয়ে শারমিনের ক্লাসের দেরী করিয়ে দেয়, কিন্তু আজ ব্যতিক্রম। নারমিন এমন একটা ভাব করলো যেনো শারমিনকে ও দেখতেই পায়নি! বরং নারমিনের বন্ধুরা অনেকেই “আপু আপু” বলে শারমিনের কাছে ছুটে এলো! কেউ কেউ আবার শারমিনের কাছে মারামারি শিখতে চাইলো!! কিছুটা মন খারাপ করে আর স্যারদের কাছে বকার খাওয়ার ভয় নিয়ে শারমিন নিজের ক্লাসে ঢুকলো, ক্লাসে পা দেয়া মাত্র সবাই তালি দেয়া শুরু করলো! তালির আওয়াজে যেনো এই স্কুলের পুরাতন বিল্ডিংয়ের ছাঁদই উড়ে যাবে!! শারমিন কয়েকবার সবাইকে থামতে বললো কিন্তু কেউ ওর কথা শুনতে পেলো না, অবশেষে নিজেরা নিজেরাই সম্ভবত ক্লান্ত হয়ে তালি থামিয়ে দিলো! ওদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় আলম এগিয়ে এসে নেতাদের অনুকরণে বললো, “আমাদের হিরো ম্যাডাম কে স্বাগত জানাচ্ছি! গুন্ডা রাজুর নাকি ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি! যে কাজ আমাদের ক্লাসের আঠারোজন ছেলে করতে পারেনি, সেই কাজ শারমিন তুমি একাই করেছো! Bravo!” ক্লাসের আরেক মেয়ে মেহেরিন বলে উঠলো, “ভাই আজ কাউকে সাইজ করবে না তো! অবশ্য আজ তোমার চুল সুন্দর করে, সুন্দর ফিতা দিয়ে বাঁধা! মনেহয় আজ তোমার ভুতটা এখনো ভর করে নাই! যেদিন যেদিন তোমার চুল আউলা থাকে সেদিন তোমার ভুতটা তোমার সাথে থাকে!” সবাই হেসে মেহেরিনের সাথে যোগ দেয়! বোকার মতোই শারমিন দাঁড়িয়ে থাকে...সাদিয়া আর সুলতান এসে সবার উদ্দেশ্যে বলে, “সবাই এবার থামো! অনেক মজা নিসো!” শারমিন বেঞ্চে বসে চিন্তা করার আগেই আলম মোবাইল নিয়ে হাজির! শারমিনের উদ্দেশ্যে মোবাইল এগিয়ে দিয়ে বলে, “শারমিন দেখো তোমার গতকালের ফাইটিং সিন!” শারমিন দেখে ও মাটিতে ফেলে ক্রমাগত মারছে গুন্ডা রাজুকে! তিন সেকেন্ডের বেশী দেখতে পারে না ও, মোবাইলটা ফিরিয়ে দেয় আলমকে!
নতুন বছরের শুরু, এই সময় স্কুলে চলে বার্ষিক খেলা-ধূলার প্রতিযোগিতা, পিকনিক, বিভিন্ন অনুষ্ঠান! এই সময়ে ক্লাসগুলো ঠিকমতো হয় না! শারমিন এইবার ক্লাস টেনে উঠলো, ও আর্টস এর ছাত্রী, ছাত্রী হিসাবে ও খুব একটা ভালো না, অংক, ইংলিশ, আর বিজ্ঞানে ও অনেক কাঁচা। কিন্তু ওদের গ্রামে শারমিনের একটা সুনাম আছে, সেটা হচ্ছে ও নাকি গ্রামের সবচেয়ে ভালো মেয়ে। শারমিনের বাবা মারা গেছে অনেক আগে, নারমিন আর ওর দাদীকে নিয়েই ওদের সংসার। শারমিনের মা একজন ইউপি সদস্য এবং গ্রামের উন্নয়নের জন্য উনি সবসময় ব্যস্ত!
পর্ব - ২
উদয়ের ঘুম ভাংলো বেশ দেরী করে, উঠে দেখে ঘড়িতে প্রায় ১১টা বাজে! আজ স্কুল মিস! উদয় ঢাকার নামকরা স্কুলে পড়ে ক্লাস টেনে, সাইন্সে পড়ে। ঘুম থেকে উঠেই ও টের পায় শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা করছে বিশেষ করে ওর ডান পায়ে! অনেক কষ্টে বিছানা থেকে উঠে বসে ও, বুঝতে পারে গতকাল ও নিশ্চই আবার কারো সাথে মারামারি করেছে, কিন্তু ওর তেমন কিছুই মনে পড়ছে না!! শুধু মনে পড়ছে সুন্দর একটা গ্রাম, কুয়াশা ঘেরা ঠাণ্ডা একটা সকাল, যেন একটা সুন্দর স্বপ্ন। ঢাকায় সেইরকম কোন ঠাণ্ডাই পড়ে নি এইবার, ফ্যান ফুল স্পীডে ছাড়তে হয়! কিন্তু ওর বাবা ওকে স্কুলে যাবার জন্য কেন ডাকেনি সেটা বুঝতে পারলো না উদয়! ওদের বাসা মহাখালির আরজত পাড়াতে, ওর রুমের বারান্দা আর জানালা দিয়ে ফ্লাইওভারটা পরিষ্কার দেখা যায়! তাই চব্বিশঘণ্টা বাস-ট্রাকের আওয়াজ তো আছেই, আর সাথে আছে ট্রেনের ভেঁপুর বিকট আওয়াজ! কিন্তু গতকাল এতো বেশী ক্লান্ত ছিলো যে, এইসব কিছুই ওর ঘুম ভাংগাতে পারেনি। কিছুটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে ও ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমের দিকে গেলো, যেয়ে দেখলো ফ্রিজের গায়ে একটা চিরকুটে ওর বাবা লিখে গেছে, “আব্বু, আরাম করে ঘুমাচ্ছো দেকে ডাকলাম না। গতকালের রান্না খুব মজা হয়েছিলো কিন্তু আজ আর রান্না করার কথা চিন্তাও করো না। টাকা রেখে গেলাম, খেয়ে নিও, রাতে আমি এসে রান্না করবো।”
গতকালে উদয় রান্না করেছিলো, ও পড়ে অবাক হয়ে গেলো! ও তো চাটাও ঠিকমতো বানাতে পারে না। গতকালের কিছুই ও মনে করতে পারলো না, কখন রান্না করলো? কি রান্না করলো? যাহোক, বাবার বানানো নাস্তা খেয়ে, পাঁচশত টাকার নোটটা হাতে নিয়ে চিন্তা করলো স্কুলের বাইরে বসে অপেক্ষা করবে, স্কুল ছুটি হলে বন্ধুদের সাথে যেয়ে ক্যাপ্টেনস ওয়ার্ল্ড এ কিছু খেয়ে নিবে।
পর্ব - ৩
দুপুরের আগেই শারমিনদের স্কুল ছুটি হয়ে যায়। শারমিন নারমিনের ক্লাসে যেয়ে ওকে দেখতে পায় না, শুনে ও নাকি ওর বন্ধুদের সাথে বাড়ি চলে গেছে! ফুপুর বাসা থেকে দাদীর এতক্ষণে চলে আসবার কথা! কিন্তু না এসে থাকলে নারমিনকে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে! শারমিনদের গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি, কিছু কিছু বাড়িতে সোলার প্যানেল দিয়ে ফ্যান, লাইট চালানো হয়। আর ইন্টারনেট এইখানে টুজি, অবশ্য মোবাইল এখনো এইগ্রামে হাতে গোনা কয়েকজন মানুষের কাছে আছে। শারমিন ওর বাসার দিকে পা বাড়ায় নারমিনের উপর একটু বিরক্ত হয়ে, মনে মনে ভাবে, “ছোটদের এতো বেশী মান-সন্মান জ্ঞান থাকলে সমস্যা!”
পিছন থেকে সাদিয়া আর সুলতান ডাক দেয় শারমিনকে। সাদিয়া বলে, “শারমিন দাঁড়া, এতো দৌড়ে কোথায় যাচ্ছিস!? বিকেলে দেখা করবি?!”
শারমিন কিছুটা অবজ্ঞাভরে বলে, “কোথায় আর দেখা করবি? সেই নদীর ধারে? এই ঠাণ্ডার মধ্যে?!” সুলতান দুষ্টমি করে উত্তর দেয়, “না না, তোমাকে ক্যাফেতে কফি খাওয়াতে নিয়ে যাবো! জানো না, নতুন ক্যাফে খুলেছে গ্রামে?!” শারমিন প্রথমে ভাবে সুলতান আন্তরিক ভাবেই কথাটা বলেছে, পরে সাদিয়ার হাসি শুনে সুলতানের ব্যাঙ্গ ভাব বুঝতে পারে আর রেগে যেয়ে চিৎকার করে বলে, “এই পচা গ্রামে কিছুই নাই! আমি ঢাকার মহাখালিতে চলে যাবো! কেন যে আমি ঢাকায় ছেলে হয়ে জন্মাইলাম না!!! এই গ্রাম আমার ভালোই লাগে না!”
ওর চিৎকার শুনে স্কুল ফেরত অনেক ছাত্র ছাত্রী ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে! আসলে অনেকের মনের কথাই বলেছে শারমিন! কিন্তু সাদিয়া বেরসিকের মতো বলে উঠে, “কিরে, তোর আবার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে নাকি??! আবার রেগে উঠলি যে!! তোকে সুরেশ্বরের মাজারে নিয়ে ফুঁ দিয়ে আনতে আমি আজই খালাম্মাকে বলবো!” সুলতান বলে উঠে, “বিয়ে দিলেও আমি শুনছি মাথা খারাপ ঠিক হয়ে যায়, শারমিন দেখতে শুনতে খারাপ না, চেষ্টা করলে ঢাকার মহাখালিতে ভালো কোন ছেলে অবশ্যই ম্যানেজ করা যাবে আমাদের শারমিনের জন্য!” শারমিন এইবার হেসে ফেলে, “থাক আমাকে নিয়ে তোমাদের এতো চিন্তা করতে হবে না! আমি গেলাম বাড়িতে, বিকেলে দেখা হচ্ছে!”
বাড়ি ফিরে শারমিন দেখে দাদী ফিরেছে আর ফুপুদের বাসার থেকে অনেক খাবারও এনেছে। পোলাও, রুই মাছ ভাজি, দেশি মোরগের তরকারী। ভরপেট খেয়ে শারমিন একটু ঘুমাতে যায়, শুয়ে শুয়ে চিন্তা করে আসলেও ওর হলো কি?! কিছু একটা হয়েছে সেটা নিয়ে ওর কোন সন্দেহ নাই কারন ও জীবনেও ঢাকা যায় নাই, কিন্তু ঢাকায় যে মহাখালি বলে একটা জায়গা আছে সেটা ও জানলো কিভাবে? আর যদিও বা মহাখালি নামটা শারমিন কারো কাছ থেকে শুনে থাকে তাহলে ওর কেন মনে হচ্ছে মহাখালি এলাকাটাতে অনেক গুলো ভালো খাবারের দোকান আছে...আছে সুন্দর মার্কেট আর রেললাইন! ট্রেনের আওয়াজ ও জীবনেও শুনেনি কারন এই অঞ্চলে শুধু ট্রলার, নৌকা, আর ষ্টীমার চলে, কিন্তু যেনও চোখ বন্ধ করলেই ও আবছা ভাবে দেখতে পায় ফ্লাইওভার আর তার উপর দিয়ে চলাচল করা বাস ট্রাক!! কেন এইরকম হচ্ছে ওর! ও কিছুক্ষণ চিন্তা করে খাতা থেকে পেইজ ছিঁড়ে লিখে, “আমার নাম শারমিন, আমি শরিয়তপুরের মায়ার চর গ্রামে থাকি।” তারপর কাগজটা ওর পায়জামার পকেটে রেখে দেয়! আরাম করে কম্বল মুড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ও।
পর্ব - ৪
উদয় ওর বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু জামি এস,এম,এস করে ওকে জানায় আজ একটু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কারন প্রিন্সিপ্যাল জামিসহ কিছু কিছু ছাত্র-ছাত্রীকে ডেকে নিয়েছে কোন একটা কাজে! ক্যাপ্টেনস ওয়ার্ল্ড এ বসে, দোতালার জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতে দেখতে কিছুটা ঝিমুনি এসে ওর মধ্যে, সেই জ্যাম, গাড়ি, বালি, ধূলা, গাড়ি বাইকের হর্নের শব্দে কানের পর্দা ফেটে যাবার জোগাড়!! ঢাকা ছেড়ে যদি কোন শান্ত সুবজ গ্রামে পালিয়ে যাওয়া যেতো! জামির ডাকে ঝিমুনি কাটে ওর। “উদয় কি ঘুমিয়ে গেলি নাকি!? কি রে উঠ!” কিন্তু উঠে উদয়ের ধাতস্ত হতে সময় লাগে, আবার মাথার ভিতর শূন্যতা! জামি তাড়া দেয়, “উদয়, তাড়াতাড়ি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আয়। তারপর খাবারের অর্ডার করছি! অনেক ক্ষুধা লেগেছে! কিরে যা!” উদয় বোকার মতো প্রশ্ন করে, “ওয়াশরুম কোন দিকে?!” জামি বিরক্ত হয়ে বলে, “আবার পাগলামি?! তোর কি হয় বলতো?! সেই ক্লাস ওয়ান থেকে এইখানে আসি আমরা, এখন তোকে বাথরুম চিনাতে হবে?! কোন মানে হয়?!” উদয় কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুমের সাইন দেখে ভিতরে ঢুকে পরে। মুখে পানি দিয়ে রুমাল নেয়ার জন্য ট্রাওজারের পকেটে হাত দিলে সেইখানে পায় একটুকরা কাগজ যেটাতে লিখা, “আমার নাম শারমিন, আমি শরিয়তপুরের মায়ার চর গ্রামে থাকি।” ও অবাক হয়ে কাগজটির দিকে তাকিয়ে থাকে! এই কাগজের টুকরোটি এলো কোথা থেকে!!
পর্ব - ৫
শারমিনকে ঘুম থেকে জাগায় সাদিয়া, ওকে রীতিমত ঝাঁকাতে থাকে আর সাথে বলতে থাকে, “শারমিন উঠ! তোর জন্য কতক্ষণ থেকে নদীর পারে বসে আছি, জানিস!?” শারমিন ওকে কোন মতে সরিয়ে দিতে দিতে বলে, “আপনি আমার গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?! আজীব!” সাদিয়া এইবার রেগে উঠে, “আবার তোর সেই ভুত?! দাঁড়া আজ তোর মাথায় লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে ভুত ভাগাবোই নইলে আমার নাম সাদিয়া না!” শারমিন কোন রকমে বলে, “স্যরি মজা করছিলাম দোস্ত!”
সাদিয়া, “দোস্ত?! হুম, ভুত এখনো পুরাপুরি পালায় নাই! মুখ ধুয়ে নে, পুকুর পারেই বসি কিছুক্ষণের জন্য!” শারমিন সাদিয়াকে জিজ্ঞাসা করে, “বাথরুম কোন দিকে?!”
পর্ব - ৬
কিছু মাস পরের কাহিনী, শারমিন প্রতিদিন এখন সকালে উঠেই ওর পকেটে রাখা ছোট ডাইরিটা খুলে দেখে, ও জানে এটা অসম্ভব হলেও সত্যি যে, ও আর ঢাকার একজন ছেলে উদয়, ওরা একজনের সাথে আরেকজন স্থান পরিবর্তন করতে পারে, সেটা সাধারণত হয় ঘুম ভাংগার পর, হঠাৎ করেই, ইচ্ছা করলে ওরা এটা করতে পারে না। আর তাই ওরা একজন আরেকজনের জন্য নোট রাখে এই ডাইরিতে। শারমিন আজ সকালে উঠে পড়তে থাকে উদয়ের নোট, “শারমিন তোমাকে ধন্যবাদ, তোমার জন্য সমাজ বিজ্ঞান আর বাংলায় বেশ ভালো নাম্বার পেয়েছি! আর তুমি এতো সুন্দর করে আমাদের বাসা গুছিয়ে দিয়েছ...আব্বু আমার উপর খুব খুশি! আব্বু পিঠা খুব পছন্দ করে, আম্মু বেঁচে থাকতে অনেকরকম পিঠা বানাতো। তুমি লিখে দিও পাটিসাপটা পিঠা বানাতে কি কি লাগবে? আমি কিনে রাখবো আর তুমি বানিয়ে রাখবা! হাহাহা!! ব্যপারটা খুবই মজার! একটা মোবাইল কিনে নাও, তাহলে আমরা কথা বলতে পারবো! ইতি-উদয়।”
শারমিন উত্তর দিতে বসে, “উদয় তোমাকেও ধন্যবাদ, তোমার কারনে আমি বিজ্ঞান আর ইংরেজিতে এখন ক্লাসে অনেক ভালো করছি! কিন্তু চিন্তা করছি, আসল পরীক্ষাতে কি হবে? কারন আমার জায়গায় তুমি আর তোমার জায়গায় আমি যদি পরীক্ষা দিতে বসি তাইলে দুইজনই ফেইল করবো! হাহাহা!! পিঠার কথা বলার আগে বলে নেই, আমাদের জন্মদিন একই। জন্মের সময়টা পর্যন্ত একই! সেইজন্যই কি এমন হচ্ছে?! যাহোক, আম্মুকে অনেক বুঝিয়েছি তার নিজের জন্যই একটা মোবাইল কিনতে, এখন দেখা যাক! আমি ঢাকা আর ক্যাপ্টেনস ওয়ার্ল্ড এর খাবার মিস করছি! পারলে বেড়িয়ে যাও, তোমাকে দেখতে অনেক ইচ্ছা করে! ইতি শারমিন।”